মধু গাছ স্টেভিয়া
Blog

মধু গাছ : স্টেভিয়া

স্টেভিয়া পৃথিবীর এক অত্যাশ্চর্য মিষ্টি গুল্ম জাতীয় ভেষজ গাছ। এ গাছ শত শত বছর ধরে প্যারাগুয়ের পাহাড়ি অঞ্চল রিওমন্ডে এলাকায় চাষাবাদ হতো। ১৮৮৭ সালে সুইজারল্যান্ডের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ড. এমএস বার্টনি স্টেভিয়াকে প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।প্যারাগুয়ের গুরানী ইন্ডিয়ান নামক উপজাতীয়রা একে বলে- কা-হি-হি অর্থাৎ মধু গাছ। আফ্রিকাতে এটি মধু পাতা বা চিনি পাতা নামে পরিচিত। এছাড়াও থাইল্যান্ডে মিষ্টি ঘাস, জাপানে আমাহা সুটেবিয়া ও ভারতে মধু পারানি নামে স্টেভিয়াকে অভিহিত করা হয়।

১৯৬৪ সালে প্যারাগুয়েতে প্রথম স্টেভিয়ার বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়। জাপানে চাষাবাদ শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। তখন থেকে বিভিন্ন দেশে বিশেষত ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পেরু, চীন, কোরিয়া, আমেরিকা, কানাডা, ইসরাইল, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, মালেশিয়াসহ প্রভৃতি দেশে এটি ফসল হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্র্যাক নার্সারি ‘ব্র্যাক ঔষধি-১১’ নামে স্টেভিয়ার টিস্যু কালচার চারা বাজারজাত করছে। এর মাতৃগাছটি সংগ্রহ করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে।

স্টেভিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম Stevia rebaudiana এবং এটি Compositae পরিবারভুক্ত গাছ। গাছটি বহুবর্ষজীবী এবং ৬০ থেকে ৭৫ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতার আকার বর্ষাকৃতি, ফুল সাদা এবং বীজ ক্ষুদ্রকৃতি। স্টেভিয়া গাছের পাতার নির্যাস চিনির চেয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি।
তবে সুখবর হল এর মধ্যে কোনো কার্বোহাইড্রেট কিংবা ক্যালরি নেই, তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিনির সবচেয়ে ভালো প্রাকৃতিক বিকল্প। এছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস বিনষ্টকারী প্রাকৃতিক রাসায়নিক উপাদান।

এ গাছের মিষ্টি উপাদানের নাম হল Steviol †lycosides যা সংক্ষেপে Stevioside নামে পরিচিত। এই অগ্নাশয়ের বিটা কোষের সক্রিয়তার মাধ্যমে ইনসুলিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে এবং ব্লাড সুগার লেভেল অনেকটা কমিয়ে রাখতে পারে।

স্টেভিয়ার সবুজ ও শুকনো পাতা গুলো সরাসরি চিবিয়ে কিংবা চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়। পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে বোতলে সংরক্ষণ করা যায়।

পাতার গুঁড়ো দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি করে ডায়াবেটিস রোগীরা খেতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত এ ঔষধি গাছের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। জাপানে হালকা পানীয় কোকাকোলাতে স্টেভিয়া ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কনফেকশনারি, ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্যে চিনির বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। চা ও কফিতে স্টেভিয়ার ব্যবহার বিশ্বব্যাপী।

আমেরিকাতে কোকাকোলা কোম্পানি জবনরধহধ নামে স্টেভিয়া বাজারজাত করে থাকে। বিভিন্ন সময় চিনি রফতানিকারক দেশসমূহ ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো স্টেভিয়াতে বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে বলে প্রচারণা করলেও সাম্প্রতিক সময়ে USFDA (United State Food and Drug Administration) এর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এর মধ্যে কোনো প্রকার বিষাক্ত পদার্থ নেই।

স্টেভিয়ার বিশেষ কার্যকারিতা : ডায়াবেটিস এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে, উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে, লিভার, অগ্ন্যাশয় এবং প্লীহাকে পুষ্টি সরবরাহ করে, স্টেভিওসাইড অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ করতে সাহায্য করে, ত্বকের ক্ষত নিরাময় করে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে E. colimn বিভিন্ন প্রকার দমন করে। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, খাদ্য হজমে সাহায্য করে, স্থূলতা প্রতিরোধ করে কারণ স্টেভিয়ার কোনো ক্যালোরি নেই, ওজন কমাতে সাহায্য করে, মিষ্টি খাবারে চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, খাবারের মান ও স্বাদ উন্নত করে, স্বাস্থ্য ও সতেজতার অনুভূতি তৈরি করে।

উৎপাদন কৌশলঃ বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু স্টেভিয়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এদেশে সারা বছরই সফলভাবে স্টেভিয়া চাষ করা যাবে বলে আসা করা যায়।

সুনিষ্কাশিত এবং জৈবভাবে সমৃদ্ধ বেলে দোআঁশ মাটি স্টেভিয়া জন্মানোর জন্য ভালো। স্টেভিয়া লাল মাটি এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষারীয় মাটিতে সবচেয়ে ভালো জন্মে। আমাদের দেশে যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না সেখানে সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে স্টেভিয়ার চাষ করা উচিত।

বিশ্বে প্রায় ৯০ প্রজাতির স্টেভিয়ার রয়েছে। এর বিভিন্ন জাত বিভিন্ন আবহাওয়ার জন্য উপযোগী। স্টেভিয়ার গুণমান নির্ভর করে এর পাতায় উপস্থিত স্টেভিওসাইডের উপর।
পাতায় স্টেভিওসাইড উৎপাদন গাছের বয়স, জাত এবং জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। বাণিজ্যিক গ্রেড স্টেভিয়া পাতায় কমপক্ষে ১০% স্টেভিওসাইড থাকতে হবে।
স্টেভিয়া সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে বেডে চাষ করতে হয়। বেডের উচ্চতা কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি হতে হবে। বিছানা সারি থেকে সারিতে এক ফুট এবং গাছ থেকে সারিতে ৬ ইঞ্চি দূরত্ব রাখতে হবে। ৫ থেকে ৬ টি চাষ দিয়ে জমি ভালভাবে প্রস্তুত করতে হবে। জমির উপরের অংশ মই দিয়ে ভেঙ্গে মিহি করতে হবে।

দুভাবে স্টেভিয়ার বংশবৃদ্ধি করা যায়। প্রথমত টিস্যু কালচার পদ্ধতি এবং দ্বিতিয়ত স্টেম কাটিং পদ্ধতি। তবে টিস্যু কালচার সবচেয়ে ভালো ও লাভজনক পদ্ধতি। কারণ স্টেম কাটিং এ সফলতার হার খুবই কম এবং কাটিং এ শিকড় গজাতে অনেক বেশি সময় লাগে। বীজ থেকে চারা গজালেও অঙ্কুরোদগমনের হার থাকে খুবই কম।

জমিতে গাছের সংখ্যা মাটি এবং জলবায়ুর উপর নির্ভর করে। তবে লাভজনক চাষের জন্য একর প্রতি ৪০ হাজার গাছ বা হেক্টর প্রতি এক লাখ গাছ লাগানো ভালো।

স্টেভিয়ার সফল চাষ মাটিতে উপলব্ধ পুষ্টির উপর নির্ভর করে। জমিতে ফসফেট ও পটাশ সারের পরিমাণ ইউরিয়ার চেয়ে বেশি হতে হবে। কারণ অতিরিক্ত ইউরিয়া সার স্টেভিয়া পাতার মিষ্টতা কমিয়ে দেয়। তাই স্টেভিয়া জন্মানোর জন্য জৈব সার সবচেয়ে ভালো।

স্টেভিয়া চাষের জন্য সারা বছর মাটির মাঝারি আর্দ্রতা প্রয়োজন। কিন্তু গাছ অতিরিক্ত আর্দ্রতা সহ্য করতে পারে না। সাধারণত শীতকালে একবার এবং গ্রীষ্মকালে ২ থেকে ৩ বার হালকা সেচের প্রয়োজন হয়। মাসে একবার বেডের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।

স্টেভিয়া পোকামাকড়ের উপদ্রব এবং রোগ কমায়। সেপ্টোরিয়া এবং স্ক্লেরোটিনিয়ার মতো রুট পচা রোগ কখনও কখনও দেখা দিতে পারে।

তবে মালচিং করলে একই সঙ্গে আগাছা দমন হয় আবার আর্দ্রতাও সংরক্ষণ হয়। খড়-কুটো, কচুরিপানা বা কম্পোস্ট দিয়ে মালচিং করা যায় যা গাছের শিকড়কে মাটির সঙ্গে সুসংহত করে।
স্টেভিয়ায় পোকামাকড়ের আক্রমণ ও রোগবালাই কম হয়ে থাকে। কখনও কখন সেপটোরিয়া ও স্কেলেরোটিনিয়াজনিত গোড়া পচা রোগ দেখা যায়।

চারা গজানোর পর্যায়ে গাছের মূল প্রায়ই কাটা হয়। এছাড়া এফিড ও সাদামাছির আক্রমণও অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়। পোকামাকড় এবং রোগজীবাণু একই সাথে নিম তেল স্প্রে করে জৈবভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এর জন্য ৩০ মিলি নিম ওয়েল/লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ফসল কাটা: সাধারণত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। এ সময় গাছের উচ্চতা ৪০ থেকে ৬০ সেমি। ফুল ফোটার ঠিক আগে পাতা সংগ্রহ করতে হবে।

এই সময়ে, পাতায় সর্বাধিক পরিমাণ স্টেভিওসাইড পাওয়া যায়। সাধারণত মাটি থেকে ১০ থেকে ১৫ সেমি. ডালপালা সহ পাতা উপরের ছাঁটাই দ্বারা সংগ্রহ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ কেজি শুকনো পাতা পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জলবায়ুতে জন্মানো স্টিভিয়া পাতায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ স্টেভিওসাইড থাকে, যা বিশ্বের অন্যত্র জন্মানো গাছের তুলনায় ১.৫ থেকে ২.০ গুণ বেশি। যে কারণে তাদের বাজারদর টাও অনেক বেশি।

পাতা শুকানো: স্টেভিয়া পাতা সংগ্রহের পর পাতা রোদে বা ড্রায়ারের মাধ্যমে শুকাতে হবে। পাতা শুকানোর জন্য কমপক্ষে ১২ ঘন্টা সূর্যালোক প্রয়োজন।

শুকানোর পর পাতা গুঁড়ো করা হয়। এক্ষেত্রে কফি গ্রাইন্ডার বা ব্লেন্ডার মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। পাউডারের এক চতুর্থাংশ গরম পানিতে মিশিয়ে ভালো করে ব্লেন্ড করে স্টেভিয়া সিরাপ তৈরি করা যায়। এই সিরাপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে।

টবে চাষ: বাড়িতে টবে বা হাঁড়িতে সহজেই স্টেভিয়া চাষ করা যায়। তবে গাছের টবগুলি রোদযুক্ত বারান্দায় স্থাপন করা উচিত। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত স্টেভিয়ার ছোট চারাগুলি সারা বছর ভাল নিষ্কাশন করা দোআঁশ মাটিতে বা দোআঁশ ও কম্পোস্ট মিশ্রিত মাটির ৮ থেকে ১০-ইঞ্চি পাত্রে রোপণ করা যেতে পারে। গাছ লাগানোর ২৫ থেকে ৩০ দিন পর পাতা সংগ্রহ করা যায়।

ফুল ফোটার ২৫ থেকে ৩০ দিন পর গাছের উপরের অংশ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। পরে গাছের গোড়া থেকে অনেক চারা বের হয় এবং ২০ থেকে ২৫ দিন পর আবার পাতা সংগ্রহ করা যায়।
বাংলাদেশে উপযোগিতা: স্টেভিয়া চাষ করে প্রতি হেক্টরে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ চাষীদের চারা সরবরাহ করে এবং তাদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে স্টেভিয়া পাতা কিনে।

আমাদের দেশে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুরেও একই পদ্ধতিতে তামাক চাষ হয়। স্টেভিয়া চাষ এই অঞ্চলে ক্ষতিকর তামাক চাষের একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদা থাকায় স্টেভিয়া চাষ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

Related posts

Leave a Comment

X
0